১ লা জুন, ১৯৯৩ সাল। আষাঢ়ের বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত তিন সহযোদ্ধা জনাব নুরুল ইসলাম, জনাব আবদুর রাজ্জাক মোল্যা এবং জনাব আবদুর রহমান মৃধা চঞ্চল জনস্রোত, অপার কর্মস্রোত, কর্মের কোলাহল থেকে দূরে অবসাদের নিত্যকার বিশ্রামাগারে ক্লান্তি অবসানে মগ্ন। প্রতিদিনের মত হাসি আনন্দের ফাঁকে ফাঁকে এলাকার সমস্যা আর তার সমাধান নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে জনগণের বহুদিনের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার সাথী সাবেক জনপ্রতিনিধি জনাব নুরুল ইসলাম সাহেব এলাকার শিক্ষার মান উন্নয়ন কল্পে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। আব্দুর রাজ্জাক মোল্যা এবং জনাব আবদুর রহমান মৃধা এ প্রস্তাবে যেন হারানো সুর খুঁজে পেলেন। তাঁদের মনে হলো দীর্ঘদিনের মনের মধ্যে অতৃপ্তির যে বেদনা অনুভূত হচ্ছে এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন তারই মহৌষধ। তিনজন একে অপরের হাতে হাত রেখে শপথ করলেন। এলাকায় একটি আদর্শ কলেজ প্রতিষ্ঠিত করাই হবে আমাদের বাকী জীবনের একমাত্র ব্রত। প্রস্তাবটির সমর্থনে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলেন অত্র এলাকার সংসদ সদস্য জনাব আবদুর রউফ সাহেবের সাথে পরামর্শ ক্রমে তাঁর সহযোগিতা কামনা করবেন। ৪ঠা জুন, ১৯৯৩ ইংরেজী তারিখ শুক্রবার জনাব রউফ সাহেব এ শুভ আহবানে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়াদিয়ে তাঁর সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেন। অতঃপর ফরিদপুর জেলার সম্মানিত জেলা প্রশাসক জনাব কে. এম নুরুল হুদা সাহেবের শরণাপন্ন হলে তিনি প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। বোয়ালমারী থানার নির্বাহী কর্মকর্তা ১৯৯৩-৯৫ সালের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব আবদুল মতিন সাহেব এবং বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (১৯৯৩-১৯৯৫ সালের) জনাব শাহ্ আলম সাহেব ও বোয়ালমারী থানার অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ তাদের সর্বপ্রকার সাহায্যের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। উপরিউক্ত আশ্বাসের প্রেক্ষিতে জনাব নুরুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক মোল্যা ও আবদুর রহমান মৃধা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অত্র এলাকার সব শ্রেণীর জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থন জানার লক্ষ্যে একটি সাধারণ সভার আয়োজন করেন। ১৯৯৩ সালের ৮/৬/৯৩ ইং তারিখে কাদিরদী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সাতৈর, জাহাপুর, চাঁদপুর, দাদপুর, ঘোষপুর,রায়পুর ইউনিয়নের সম্মানিত ইউ.পি চেয়ারম্যানগণ ও অত্র এলাকার সর্বসাধারণের এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
তখন এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বোয়ালমারী থানার থানা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব আবদুল মতিন সাহেব, প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বোয়ালমারী সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বাবু সুভাস চন্দ্র ঘোষ এবং বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব শাহ আলম সাহেব। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কাদিরদীতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জনাব নুরুল ইসলাম সাহেবের প্রস্তাবনায় সর্বসম্মতিক্রমে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কমিটি, ১১ সদস্য বিশিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক কমিটি এবং ৬৫ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সভায় হাজার হাজার জনতার স্বতঃস্ফূর্ত করতালির মধ্যে দিয়ে প্রধান অতিথি জনাব দেলওয়ার হোসেন সাহেব একশত এক টাকা কলেজ ফান্ডে দান করার কথা ঘোষণা করেন এবং তাঁর যোগ্যতা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একটি আদর্শ কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বক্ষণিক সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। উক্ত সভার সভাপতি থানা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব আব্দুল মতিন সাহেব পাঁচ হাজার টাকা এবং বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব শাহ্ আলম সাহেব পাঁচ হাজার টাকা আর্থিক অনুদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। সর্বসাধারণের পক্ষ থেকে সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতার কলধ্বনীতে কাদিরদীর আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। শুরুতেই পালে যেন বিজয়ের হাওয়া লাগতে শুরু করে। সৃষ্টির নব উদ্যোগে এবার তারা পদ্মা পাড়ি দিয়ে কলেজের জন্য জায়গার সন্ধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, অত্র এলাকার কৃতি সন্তান ডঃ মিয়া মুহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস সাহেবের শরণাপন্ন হন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের অন্যতম মৎস্য বিজ্ঞানী অত্র এলাকার শিক্ষার উন্নতি তথা সর্বসাধারণের মহৎ উদ্দেশ্য সার্থক করার এ মহান উদ্যোগে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেন। তিনি তিন একর পাঁচ শতাংশ মূল্যবান জমি উদার হস্তে দান করে এলাকার প্রতি গভীর মমত্ববোধের উজ্জল দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করেন। তিনি বাংলাদেশের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার সুচিন্তিত পরামর্শ ও সার্বক্ষণিক তদারকিসহ কলেজের সব ধরনের সমস্যা সমাধানে সাধ্যমত সহযোগিতার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
কলেজটির প্রতিষ্ঠা লগ্নে আর্থিক সংকট নিরসনের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে অত্র এলাকার দরিদ্র নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু বিশিষ্ঠ শিল্পপতি জনাব কাজী সিরাজুল ইসলাম সাহেব পঞ্চাশ হাজার টাকা উদার হস্তে দান করেন এবং প্রযোজনে এবং প্রয়োজনে আরো সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। একই সঙ্গে অত্র এলাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব আলহাজ্জ শামছুল হক সাহেব (সাম মিয়া) পঞ্চাশ হাজার টাকা কাদিরদী কলেজে দান করে নিজেকে এ মহৎ উদ্যোগে সম্পৃক্ত করেন। এভাবে একের পর এক সকল আয়োজন শেষ করে কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের শুভক্ষণকে সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিত করার লক্ষ্যে কাদিরদী গ্রামের সর্বস্তরের জনগণের েএক সাধারণ সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত সভায় কাদিরদী ত্রিভাস্করের আকুল আহবানে সাড়া দিয়ে সকল গ্রামবাসী কাদিরদী কলেজের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপনসহ সর্বপ্রকার সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ নির্ধারিত হল। ১৯৯৩ সালের ২৫শে জুন, রোজ শুক্রবার প্রকৃতির প্রতিকুল আবহাওয়া উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষের পবিত্র প্রতিধ্বনির মধ্যে দিয়ে বিশেষ অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মিয়া মোঃ আঃ কুদ্দুস সাহেব, কবি নজরুল সরকারি কলেজের (অধ্যক্ষ) সহযোগী অধ্যাপক রাবেয়া খানম এবং জনাব জাহিদুর রহমান এম. এ. এল. এল. বি এর উপস্থিতিতে অত্র এলাকার সম্মানিত সংসদ সদস্য অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জনাব আঃ রউফ মিয়ার পবিত্র বাণী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কাদিরদী কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ফলক উন্মেচন করেন এবং উক্ত ভিত্তির উপরে কলেজের ঘর নির্মাণের জন্য দশ বান্ডিল ঢেউ টিন ক্রয়ের প্রয়োজনীয় টাকা দান করেন। একই সঙ্গে কলেজ অফিস কক্ষ নির্মাণের জন্য রামদিয়অর বাবু সুধীর কুমার বসু নিজের গৃহঘর দান করে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ফরিদপুর-১ আসন থেকে নির্বঅচিত সাবেক সাংসদ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ গরীবের বন্ধু শাহ্ মোঃ আবু জাফর সাহেব কলেজের শ্রেণি কক্ষ নির্মাণের জন্য আট হাজার ইট ক্রয়ের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। হিউম্যান ড্রাগস এর মালিক এলাকার বিশিষ্ট সমাজ সেবক জনাব ডঃ আঃ মান্নান সাহেব কলেজটির বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এ শুভ উদ্যোগে শরিক হয়েছেন। মধুখালী থানার প্রাক্তন উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম মাহমুদুন নবী সাহেবের আন্তরিক সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে কলেজের ইতিহাসের পাতায় স্মরণ করে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। কলেজটির দ্বিতল ভবন নির্মাণে জাতীয় শিক্ষা কমিটির সম্মানিত সদস্য ফরিদপুর-১ আসন থেকে নির্বাচিত সম্মানিত সাংসদ জনাব আঃ রউফ মিয়া সাহেবের প্রয়াসকে সাফল্য মন্ডিত করার লক্ষ্যে ফরিদপুর জেলার সম্মানিত জেলা প্রশাসক জনাব কে. এম. নুরুল হুদা সাহেবের প্রশাসনিক প্রভাব বিশেষ করে দ্বিতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে। এলাকার সর্বসাধারণ ও বিশেষ করে কাদিরদী’র যুবক সম্প্রদায়ের গভীর আন্তরিকতা এবং তিল তিল শ্রম ও সার্বিক সহযোগিতা স্মরণে রাখার মতো।
এ কলেজটির সাধ আর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অতি সঙ্গোপনে, সযতনে, হৃদয়ের গভীর প্রদেশ থেকে অকৃত্রিম স্নেহ দিয়ে, সদ্যজাত শিশুটির পরিচর্যার ভার যিনি নিয়েছেন, সেই মহান ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট শিল্পপতি সমাজ সেবক, যমুনা গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজ (পাবনা) এর এম.ডি জনাব সৈদয় আবু জাফর (মশরু মিয়া) সাহেবের নামটি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে কৃতজ্ঞতা ভরে কলেজ সৃষ্টি ইতিহাসের পাতায় স্মরণ করছি। কলেজটির শুরু থেকে সকল শিক্ষকদেরও শিক্ষকতার মহান ব্রত, আর কর্মচারীদের সেবার মনোভাব নিয়ে নিজেদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণরূপে উজাড় করে স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাদিরদী কলেজকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ নুরুজ্জামান মোল্যা সাহেব হাজারো সমস্যা সমাধানে নিজের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা আর বিচক্ষণতার সমন্বয়ে প্রশাসনিক কাঠামোকে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সততা, একনিষ্ঠতা আর নিরলস শ্রম দিয়ে দক্ষতার সাথে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে কাদিরদী কলেজকে সারা বাংলাদেশের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। পরিশেষে সাধ আর সাধ্যের টানাটানিতে কলেজের ঐতিহাসিক সংক্ষিপ্ত পটভূমিকায় অগনিত দানবীর, শুভাকাঙ্খী, মহৎ ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করতে না পারায় এ অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে দুঃখিত।